পয়গম্বর ঈসা (আলেয়হিস সালাম) ইসলাম ধর্মে

ইসলামে পয়গম্বর ঈসা (আলেয়হিস সালাম), যিনি ইংরেজিতে Jesus নামে পরিচিত, আল্লাহর একজন মহান পয়গম্বর হিসেবে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়। তিনি এক রসূল হিসেবে বিবেচিত হন, যিনি তার সময়ের মানুষের জন্য আল্লাহর দিকনির্দেশনা এবং শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন। তার কাহিনী কুরআনের বিভিন্ন অংশে বর্ণিত হয়েছে, এবং তার জীবন, অলৌকিক ঘটনা এবং বার্তা ইসলামিক বিশ্বাসের কেন্দ্রীয় অংশ। নিচে, আমরা ইসলাম ধর্মে পয়গম্বর ঈসা (আলেয়হিস সালাম)-এর ভূমিকা আলোচনা করব।

1. পয়গম্বর ঈসা (আলেয়হিস সালাম)-এর অলৌকিক জন্ম

পয়গম্বর ঈসা (আলেয়হিস সালাম) অলৌকিক পরিস্থিতিতে জন্মগ্রহণ করেন, কারণ তার মা, মেরিয়াম (মেরি), ছিলেন কুমারী। কুরআনে তাকে একটি ধার্মিক এবং পবিত্র মহিলারূপে বর্ণনা করা হয়েছে, যাকে আল্লাহ চয়ন করেছিলেন একটি সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য, এবং এটি ছিল আল্লাহর ইচ্ছায় একটি অলৌকিক ঘটনা। ফেরেশতা জিবরিল (জিবরাইল) মেরিয়ামের কাছে এসেছিলেন এবং তাকে আল্লাহর আদেশ পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেবেন, যা আল্লাহর মহিমা ছিল।

মেরিয়ামের গর্ভাবস্থা তার জন্য একটি বড় পরীক্ষা ছিল, এবং তার সম্প্রদায়ের মানুষরা প্রথমে তার পবিত্রতা নিয়ে সন্দেহ করেছিল। তবে, যখন তিনি তার নবজাতক পুত্র, পয়গম্বর ঈসা (আলেয়হিস সালাম)-কে মানুষের সামনে নিয়ে আসেন, তিনি পালঙ্ক থেকে কথা বলেন এবং ঘোষণা করেন যে তিনি আল্লাহর দাস এবং পয়গম্বর। এটি তার বিশেষ মর্যাদার একটি অলৌকিক সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত।

পয়গম্বর ঈসা (আলেয়হিস সালাম)-এর জন্ম আল্লাহর ক্ষমতা এবং রহমতের একটি নিদর্শন। কুরআন মেরিয়ামকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধার্মিক মহিলাদের একজন হিসেবে সম্মানিত করেছে, এবং তার পুত্রের জন্মের কাহিনী আল্লাহর একটি অলৌকিক উপহার হিসেবে বিবেচিত, যা প্রমাণ করে যে আল্লাহর ক্ষমতা সব প্রাকৃতিক আইনকে অতিক্রম করে।

2. পয়গম্বর ঈসা (আলেয়হিস সালাম)-এর জীবন এবং শিক্ষা

পয়গম্বর ঈসা (আলেয়হিস সালাম) তার জীবন আল্লাহর ইবাদত ও তার বার্তা প্রচারের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তার শিক্ষা মূলত একেশ্বরবাদ, ন্যায়, দয়া এবং তওবা নিয়ে ছিল। তিনি মানুষকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন, এবং নম্রতা, দানশীলতা, এবং অন্যদের প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন।

ইসলামে পয়গম্বর ঈসা (আলেয়হিস সালাম)-এর বার্তার একটি মূল দিক ছিল যে তিনি নিজেকে দিভ্য বলে দাবি করেননি। ইসলাম শেখায় যে ঈসা (আলেয়হিস সালাম) একজন পয়গম্বর এবং আল্লাহর দাস, তিনি ঈশ্বরের পুত্র নন। খ্রিস্টান শিক্ষার বিপরীতে, মুসলমানরা ঈসা (আলেয়হিস সালাম)-এর দিভ্যতা বিশ্বাস করেন না, তবে তাকে পাঁচ মহান পয়গম্বরের একজন হিসেবে সম্মানিত করেন (যাদের মধ্যে নূহ, ইবরাহিম, মুসা, এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আছেন)।

পয়গম্বর ঈসা (আলেয়হিস সালাম) আল্লাহর অনুমতি নিয়ে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছেন, যার মধ্যে অসুস্থদের সুস্থ করা, মৃতদের জীবিত করা, এবং অন্ধদের দেখতে দেয়া অন্তর্ভুক্ত। এই অলৌকিক ঘটনাগুলি তার পয়গম্বরিত্ব এবং আল্লাহর শক্তি তার মাধ্যমে কাজ করার একটি চিহ্ন ছিল। তবে, তার অলৌকিক ঘটনাগুলি সর্বদা একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের দিকে মানুষকে আহ্বান করার উদ্দেশ্যে ছিল, নিজেকে মহান হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য নয়।

তার জীবনের অধিকাংশ সময়, পয়গম্বর ঈসা (আলেয়হিস সালাম) তার শিষ্যদের কাছ থেকে বিরোধিতা এবং অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তার অলৌকিক ঘটনাগুলি এবং ন্যায়ের আহ্বানের পরেও, তার সময়কার অনেক ধর্মীয় নেতারা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যার ফলে তাকে অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। তবুও, পয়গম্বর ঈসা (আলেয়হিস সালাম) তার বার্তা পৌঁছাতে স্থির ছিলেন এবং প্রতিকূলতার মুখেও ধৈর্য এবং দয়ালুতা দেখিয়েছিলেন।

3. ক্রুসিফিকেশন: ইসলাম এবং খ্রিস্টানত্বের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য

ইসলামী এবং খ্রিস্টান শিক্ষার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যগুলির একটি হলো পয়গম্বর ঈসা (আলেয়হিস সালাম)-এর ক্রুসিফিকেশন সম্পর্কিত বিবরণ। খ্রিস্টানত্বে বিশ্বাস করা হয় যে ঈসা (আলেয়হিস সালাম) ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন, মানবজাতির পাপের জন্য মৃত্যুবরণ করেছেন এবং মৃত থেকে জীবিত হয়েছেন। তবে, ইসলামে ক্রুসিফিকেশন অন্যভাবে বোঝা হয়।

কুরআনের মতে, ঈসা (আলেয়হিস সালাম) ক্রুশবিদ্ধ হননি, এবং তিনি ক্রুশে মৃত্যুবরণ করেননি। এর পরিবর্তে, আল্লাহ তাকে নিজের কাছে উঠিয়ে নেন, এবং তার স্থানে অন্য একজন ব্যক্তিকে ঈসা (আলেয়হিস সালাম)-এর মতো করে বানানো হয় এবং তাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। এই বিশ্বাস কুরআনের আয়াতগুলির উপর ভিত্তি করে, যেমন সুরা আন-নিসা (4:157), যা বলে: "আর তারা তাকে হত্যা করেনি, এবং তাকে ক্রুশবিদ্ধও করেনি; বরং [আরেকজন] তাদের সামনে তার মতো দেখানো হয়েছিল।" এর মানে হল যে পয়গম্বর ঈসা (আলেয়হিস সালাম) খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত্যুবরণ করেননি, বরং আল্লাহ তাকে শত্রুদের থেকে রক্ষা করেছেন এবং তাকে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন।

এটি ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস, কারণ এটি আল্লাহর এককত্ব এবং দিভ্যতা প্রতিষ্ঠিত করে। ঈসা (আলেয়হিস সালাম) একটি পয়গম্বর হিসেবে বিবেচিত, এবং তার মিশন ছিল মানুষকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতে আহ্বান করা, অন্যের পাপ বহন করা নয়। তার আসমানে উঠে যাওয়া তার উচ্চ মর্যাদার এবং আল্লাহর তার জীবন সুরক্ষিত রাখার একটি চিহ্ন হিসেবে দেখা হয়।

ইসলামী ঐতিহ্য শেখায় যে ঈসা (আলেয়হিস সালাম) ভবিষ্যতে ফিরে আসবেন, যা কিয়ামতের দিনগুলির অংশ হিসেবে ঘটবে। তার দ্বিতীয় আগমন হবে সময়ের শেষের একটি চিহ্ন, এবং তিনি মিথ্যা মেসাইয়া (দাজ্জাল) কে পরাজিত করবেন এবং পৃথিবীতে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন, এর পর আল্লাহর চূড়ান্ত বিচার কার্যকর হবে।