প্রকেত মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের চূড়ান্ত নবী হিসেবে বিবেচিত, যিনি তাঁর নেতৃত্ব, নৈতিক চরিত্র এবং মানবজাতির উপর গভীর প্রভাবের জন্য সম্মানিত। তাঁর শিক্ষা এবং কাজগুলি ইসলামী বিশ্বাসের ভিত্তি এবং সারা বিশ্বে বিলিয়ন লোকের উপর প্রভাব ফেলেছে। নিচে তাঁর জীবন, শিক্ষা এবং তিনি যে উত্তরাধিকার রেখে গেছেন তা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।
প্রকেত মুহাম্মদ (সা.) 570 খ্রিস্টাব্দে মক্কা শহরে জন্মগ্রহণ করেন, যা বর্তমানে সৌদি আরবের অংশ। তিনি কুরায়শ গোত্রের একজন সদস্য ছিলেন, যাদের অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ছিল। তাঁর পিতা, আবদুল্লাহ, জন্মের আগেই মারা যান এবং তাঁর মাতা, আমিনা, মাত্র ছয় বছর বয়সে মারা যান, ফলে তিনি এতিম হয়ে যান। তাঁকে তাঁর দাদু, আবদুল মুততালিব এবং পরবর্তীতে তাঁর চাচা, আবু তালিব পালন করেন।
মাতাপিতাহীন বেড়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সততা, দয়া এবং সততার জন্য পরিচিতি লাভ করেন। তাঁকে "আল-আমিন" (বিশ্বাসযোগ্য) উপাধি দেওয়া হয়েছিল তাঁর অমল চরিত্রের কারণে। ছোটবেলা থেকেই তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং অসাধারণ পরিপক্কতা এবং প্রজ্ঞা প্রদর্শন করেছিলেন।
২৫ বছর বয়সে, তিনি খাদিজা নামক এক ধনী বিধবা মহিলাকে বিয়ে করেন, যিনি তাঁর চেয়ে ১৫ বছর বড় ছিলেন। খাদিজা ছিলেন প্রথমদের মধ্যে, যিনি তাঁর নবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাস রেখেছিলেন, এবং তাদের বিয়েটি পারস্পরিক সম্মান ও ভালোবাসার ভিত্তিতে ছিল। একসাথে, তাদের কয়েকটি সন্তান ছিল, এর মধ্যে তাদের কন্যা ফাতিমা ছিল সবচেয়ে prominent। মুহাম্মদ (সা.) এই সময়ে এক প্রকার শান্তিপূর্ণ জীবন কাটান, খাদিজার ব্যবসা পরিচালনা করে এবং সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তির খ্যাতি বজায় রেখেছিলেন।
মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনের এই সময়কাল তাঁর নৈতিক ভিত্তি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা পরবর্তীতে তাঁকে নবী হিসেবে তাঁর কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সাহায্য করেছিল। খাদিজা এবং কুরায়শ গোত্রের সাথে তাঁর সময়কাল তাঁকে এমন অভিজ্ঞতা এবং বোঝাপড়া প্রদান করেছিল, যা পরবর্তীতে তাকে তাঁর জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল।
৪০ বছর বয়সে, মুহাম্মদ (সা.) মক্কা শহরের চারপাশের পর্বতে হিরা গুহায় একাকী সময় কাটানোর জন্য গিয়েছিলেন। এই সময়েই তিনি আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) থেকে তাঁর প্রথম মেসেজ প্রাপ্তি লাভ করেন, যা ফেরেশতা জিবরিল (আলাইহিস সালাম) মাধ্যমে এসেছে। প্রথম শব্দগুলি ছিল সুরা আল-আলাক (৯৬:১): "তোমার পালনকর্তার নামে পড়ো, যিনি সৃষ্টি করেছেন।"
এই মুহূর্তটি ছিল মুহাম্মদ (সা.) এর নবুওয়াতের যাত্রার শুরু। পরবর্তী ২৩ বছর ধরে, তিনি আরও বহু আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক, আইনগত এবং রাজনৈতিক দিকের ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন আধ্যাত্মিক বার্তা পেতে থাকেন, যা পরবর্তীতে ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ, কুরআনে অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রাথমিকভাবে, মুহাম্মদ (সা.) এই উন্মোচনগুলো তাঁর পরিবারের সদস্য এবং কাছের বন্ধুদের কাছে শেয়ার করেছিলেন, যাদের মধ্যে খাদিজা এবং তার কজন আলী ছিলেন। ইসলামের প্রথম অনুসারীরা মক্কা কর্তৃক তাচ্ছিল্য, অত্যাচার এবং হুমকির শিকার হয়েছিলেন, যারা নতুন ধর্মকে তাঁদের কর্তৃত্ব ও প্রথাগত রীতির বিরুদ্ধে হুমকি হিসেবে দেখেছিল।
এত প্রতিকূলতার পরেও, প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর মিশন নিয়ে অবিচল ছিলেন। কুরআন অব্যাহতভাবে নাজিল হতে থাকে, শুধু আধ্যাত্মিক বিষয়ে নয়, বরং সামাজিক, আইনগত এবং রাজনৈতিক ব্যাপারে তার মেসেজ ছিল।
যখন মুহাম্মদ (সা.) এর বার্তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, তখন মক্কা শহরের কুরায়শ গোত্রের প্রতিরোধ বাড়তে থাকে। গোত্রের নেতারা এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের ধারনার বিরুদ্ধে হুমকি হিসেবে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি আক্রমণ করেছিল, যাদের ধ্যানধারণা ছিল তাদের পুঁজি এবং সামাজিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে।
এই সময়কাল ছিল যেখানে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) তাদের ইসলামি বার্তা প্রচারের সাথে সাথে শান্তি, ন্যায় এবং সমতা সম্পর্কিত বার্তা প্রদান করেছিলেন। তাঁর প্রতিকূলতার মোকাবিলায় দৃঢ় থাকার ক্ষমতা তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস এবং মিশনের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি প্রমাণিত করেছে।
এই কঠিন সময়ে, প্রিয় নবী (সা.) কিছু মুসলিম অনুসারীকে আফ্রিকার আদি রাষ্ট্র, আবোসিনিয়াতে (বর্তমানে ইথিওপিয়া) পাঠিয়েছিলেন, যেখানে তারা খ্রিস্টান রাজা নিগুসের অধীনে আশ্রয় নিয়েছিল, যিনি তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। এটি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং বিশ্বাসের জন্য নিপীড়িতদের রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা উজ্জ্বলভাবে প্রদর্শন করেছিল।
মুসলিমদের উপর অত্যাচারের পর, ৬২২ খ্রিস্টাব্দে, নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর অনুসারীরা মদিনা শহরে হিজরত করতে বাধ্য হন, যা ইসলামী ক্যালেন্ডারের শুরু হিসেবে পরিচিত। এটি মদিনায় মুসলিম কমিউনিটি প্রতিষ্ঠার সূচনা ছিল।
মদিনায় হিজরত ইসলামি ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। এটি মুসলিম সম্প্রদায়কে একটি নিরাপদ আশ্রয় প্রদান করেছিল এবং ইসলামকে একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে বিকাশ করতে সাহায্য করেছিল। মদিনায় পৌঁছানোর পর, নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর অনুসারীরা স্থানীয় গোত্রের দ্বারা উষ্ণভাবে অভ্যর্থিত হয়েছিলেন, যারা তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন এবং তাঁকে তাঁদের নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিল।
মদিনায়, নবী মুহাম্মদ (সা.) প্রথম ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেটি মদিনা সংবিধান নামে পরিচিত ছিল। এই চুক্তি শহরের সকল বাসিন্দাদের অধিকার এবং দায়িত্ব নির্ধারণ করেছিল, মুসলিম, ইহুদি এবং অন্যান্য গোত্রের সদস্যদের মধ্যে শান্তি, ন্যায় এবং সহযোগিতা প্রচার করেছিল।
নবী (সা.) মদিনায় প্রথম মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি মসজিদ আল-নববী নামে পরিচিত। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। এখানে নবী (সা.) نماز পড়াতেন, খুতবা দিতেন এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন।
মদিনায় হিজরত শুধুমাত্র একটি শারীরিক যাত্রা ছিল না বরং এটি ইসলামকে একটি বৈশ্বিক ধর্ম হিসেবে প্রচারের সূচনা করেছিল। ইসলামের বার্তা নতুন দেশগুলোতে পৌঁছাতে শুরু করল, এবং মুসলিম সম্প্রদায় দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল।
মদিনায় হিজরত করার পর, মুসলিম সম্প্রদায় একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, যার মধ্যে ছিল মক্কা শহরের কুরায়শ গোত্রের সাথে সামরিক সংঘর্ষ। প্রথম মুসলিম সম্প্রদায়টি ছোট ছিল এবং সামরিক শক্তি ছিল না, তবে নবী মুহাম্মদ (সা.) এর নেতৃত্বে তারা অসাধারণ সাহস এবং স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছিল।
মুসলিম এবং কুরায়শদের মধ্যে প্রথম বড় যুদ্ধ ছিল বদর যুদ্ধ, যা 624 খ্রিস্টাব্দে হয়েছিল। যদিও মুসলিমরা সংখ্যা বিচারে কম ছিল, তবে তারা একটি ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেছিল। এই যুদ্ধ মুসলিমদের মনোবল বৃদ্ধি করেছিল এবং প্রমাণিত হয়েছিল যে বিজয় কেবল সংখ্যার উপর নির্ভর করে না, বরং বিশ্বাস এবং আল্লাহর সাহায্যের উপর নির্ভর করে।
তবে, যুদ্ধ চলতে থাকে, এবং মুসলিমরা আরও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, যার মধ্যে ছিল উহুদ যুদ্ধ (625 খ্রিস্টাব্দ), যেখানে তারা কিছুটা ক্ষতি স্বীকার করেছিল। তবুও, নবী মুহাম্মদ (সা.) দৃঢ় ছিলেন এবং ধৈর্য এবং বিচক্ষণতার সাথে তাঁর অনুসারীদের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
শেষে 630 খ্রিস্টাব্দে, মুসলিমরা মক্কা শান্তিপূর্ণভাবে বিজয়ী হয়। নবী মুহাম্মদ (সা.) বড় একটি বাহিনী নিয়ে শহরে প্রবেশ করেন তবে শহরের অধিবাসীদের প্রতি দয়া দেখিয়ে, এমনকি যারা তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদের অত্যাচার করেছে তাদেরও ক্ষমা করে দেন।
নবী মুহাম্মদ (সা.) মুসলিমদের জন্য আল্লাহর চূড়ান্ত মেসেঞ্জার হিসেবে বিবেচিত এবং তাঁর শিক্ষা আজও এক বিলিয়ন মানুষকে প্রভাবিত করছে। তাঁর জীবন মুসলিমদের জন্য একটি মডেল হিসেবে কাজ করে এবং তাঁর শিক্ষা মানুষের জীবনের সকল দিক অন্তর্ভুক্ত করে, ব্যক্তিগত আচার আচরণ থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আইনগত বিষয়েও।
নবী মুহাম্মদ (সা.) এর একটি মূল শিক্ষা ছিল ন্যায়ের গুরুত্ব। তিনি সকল বিষয়ে ন্যায়পরায়ণতার প্রয়োজনীয়তা জোর দিয়েছেন এবং দুর্বল এবং নিপীড়িতদের অধিকার রক্ষা করেছেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ছিল দয়া এবং ক্ষমার গুরুত্ব।