কুরআনে আল্লাহ মহাবিশ্বের সৃষ্টির কথা কয়েকটি আয়াতে উল্লেখ করেছেন, যা তাঁর সর্বশক্তিমত্তা, জ্ঞান এবং আসমান ও জমিন সৃষ্টির ক্ষমতাকে প্রমাণ করে। এই আয়াতগুলি শুধুমাত্র শারীরিক পৃথিবীর সৃষ্টির বর্ণনা দেয় না, বরং বিশ্বাসীদেরকে আল্লাহর সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণের স্মরণ করিয়ে দেয়। নিচে, আমরা এক গুরুত্বপূর্ণ আয়াতের প্রতি মনোযোগ দেব যা মহাবিশ্বের সৃষ্টির কথা বলে, এর গভীর অর্থ এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্বে এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে।
কুরআনে মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত এবং গুরুত্বপূর্ণ আয়াতগুলির একটি সূরা আল-আম্বিয়া (21:30) থেকে পাওয়া যায়, যা আসমান, জমিন এবং মহাবিশ্বের সৃষ্টির কথা বলে। আয়াতটি এমনভাবে পড়া হয়:
"তারা কি দেখেনি যারা অবিশ্বাসী, যে আসমান ও জমিন একত্রিত অবস্থায় ছিল, তারপর আমরা তা খুলে দিলাম? এবং আমরা পানি থেকে প্রতিটি জীবন্ত প্রাণী সৃষ্টি করেছি। তারা কি তখনও বিশ্বাস করবে না?"
এই আয়াতটি মহাবিশ্বের সৃষ্টির কথা তুলে ধরে, শুরু হয় আসমান এবং জমিন থেকে। আল্লাহ বলেন যে, সৃষ্টির আগে আসমান এবং জমিন ছিল একটি একক, একত্রিত পদার্থ, যা আল্লাহ পরে আলাদা এবং প্রসারিত করেন। অনেকেই এই আয়াতটিকে বিগ ব্যাং তত্ত্বের উল্লেখ হিসেবে দেখে, যা মহাবিশ্বের উৎপত্তির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, যা কুরআনের মহাবিশ্বের সৃষ্টির বর্ণনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
এই আয়াতে আল্লাহ অবিশ্বাসীদের চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং তাদেরকে মহাবিশ্বের উৎপত্তির উপর চিন্তা করার জন্য বলেছেন এবং তাঁদের চারপাশের দুনিয়ায় আল্লাহর শক্তির নিদর্শনগুলো চিনতে বলেছেন। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে আসমান ও জমিনের সৃষ্টি একটি divinely act, যা একমাত্র আল্লাহর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এবং এটি সৃষ্টির মহানতা এবং একতার উপর প্রতিফলন করার জন্য প্রেরণা দেয়।
সূরা আল-আম্বিয়া (21:30) থেকে আয়াতটি আধুনিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সাথে একটি বিস্ময়কর সমান্তরাল হিসেবে দেখা যেতে পারে, যেমন বিগ ব্যাং। আয়াতে বর্ণিত "একত্রিত অবস্থায় ছিল" বাক্যটি মহাবিশ্বের শুরুতে বিদ্যমান সিঙ্গুলারিটির সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, যা পরে প্রসারিত হয়। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে মহাবিশ্ব একটি অসীম ছোট, ঘন পয়েন্ট হিসেবে শুরু হয়েছিল এবং পরে আজকের বিশাল মহাবিশ্বে প্রসারিত হয়েছে।
ইসলামে, এই আয়াত বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়ার সাথে বিরোধী নয় বরং আল্লাহর মহাবিশ্ব সৃষ্টির সঠিকতা নিশ্চিত করে। এটি জোর দেয় যে আল্লাহ মহাবিশ্ব এবং এর মধ্যে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং আমরা যা শারীরিক প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করি তা আল্লাহর ইচ্ছা এবং শক্তির প্রকাশ। কুরআনে বর্ণিত মহাবিশ্বের সৃষ্টি কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয় বরং আল্লাহর সৃষ্টির শক্তি এবং অপরিসীম ক্ষমতার একটি চলমান নিদর্শন।
এছাড়াও, "আমরা পানি থেকে প্রতিটি জীবন্ত প্রাণী সৃষ্টি করেছি" উল্লেখটি আধুনিক জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে পানি জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য, এবং এই আয়াতটি জীবনের জন্য মৌলিক উপাদান হিসেবে পানির গুরুত্বকে নিশ্চিত করেছে। কুরআন এই জ্ঞানটি ১৪০০ বছরেরও বেশি আগে প্রদান করেছিল, অনেক আগে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে জীবন টিকিয়ে রাখতে পানির ভূমিকা নিশ্চিত করেছিলেন।
আরেকটি আয়াত যা আসমান এবং জমিনের সৃষ্টির কথা বলে তা সূরা আত-তূর (52:35-36) থেকে। এই আয়াতটি আল্লাহর সৃষ্টির মহানত্বকে আরো একবার গুরুত্ব দেয়। আয়াতগুলি এভাবে পড়া হয়:
"তারা কি কিছু থেকেও সৃষ্টি হয়েছে, না তারা নিজেই সৃষ্টিকর্তা? অথবা তারা আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছে? বরং তারা সন্দেহে আছে।"
এই আয়াতে আল্লাহ অবিশ্বাসীদেরকে চ্যালেঞ্জ করেন, যারা তাঁর অস্তিত্ব এবং কর্তৃত্ব অস্বীকার করে, তাদেরকে দেখিয়ে যে আসমান এবং জমিন ঘটনাচক্রে সৃষ্টি হতে পারে না, এবং তারা নিজে সৃষ্টিকর্তা হতে পারে না। আয়াতটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে মহাবিশ্বের সৃষ্টি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং একটি শক্তিশালী স্রষ্টার দ্বারা পরিকল্পিত কাজ।
এই আয়াতটি বিশ্বাসীদেরকে মহাবিশ্বের অস্তিত্বের উপর চিন্তা করতে আমন্ত্রণ জানায় এবং তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে এর উৎপত্তি একটি দেবতার সৃষ্টির কাজ। আসমান এবং জমিন, এবং তাদের মধ্যে সবকিছু, আল্লাহর সৃষ্টির শক্তির নিদর্শন এবং তাঁর অস্তিত্ব এবং সমস্ত কিছুর উপর কর্তৃত্বের প্রমাণ।
সূরা আল-মুলক (67:3) একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু শক্তিশালী আয়াত যা আল্লাহর সৃষ্টির পূর্ণতা এবং বিস্তৃতির কথা বলে। আয়াতটি এভাবে পড়া হয়:
"যিনি সাত আসমান স্তরের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। আপনি তার সৃষ্টিতে কোনো অসামঞ্জস্য দেখতে পান না। তাই আপনার দৃষ্টি আসমানে ফেরান, আপনি কোনো ফাটল দেখতে পান কি?"
এই আয়াতটি আল্লাহর সৃষ্টির পূর্ণতা এবং সামঞ্জস্য তুলে ধরে। সাত আসমান, যেগুলি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ইসলামী ঐতিহ্যে মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্তর বা আঞ্চলিক রূপ হিসাবে বোঝা যায়। আয়াতটি জোর দেয় যে আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনো ত্রুটি, ফাটল বা অসামঞ্জস্য নেই, যা আল্লাহর নিখুঁত এবং ভুলহীন নকশাকে তুলে ধরে।
এই আয়াতটি বিশ্বাসীদেরকে মহাবিশ্বের বিস্তৃতির উপর চিন্তা করতে উৎসাহিত করে, এবং তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে মহাবিশ্ব আল্লাহর মহানতার নিদর্শন এবং সৃষ্টির সবকিছু এক নিখুঁত ভারসাম্যে আছে, যা একমাত্র স্রষ্টার ইচ্ছায় নিয়ন্ত্রিত।
সূরা আর-রহমান (55:33) আরেকটি আয়াত যা আল্লাহর সৃষ্টির বিস্তৃতি সম্পর্কে গুরুত্ব দেয়। আয়াতটি এভাবে পড়া হয়:
"হে জিন এবং মানব জাতি, যদি তোমরা আসমান ও জমিনের সীমা অতিক্রম করতে পার, তবে অতিক্রম করো। কিন্তু তোমরা কখনো অতিক্রম করতে পারবে না, কিন্তু আল্লাহর অনুমতি ছাড়া।"
এই আয়াতটি আল্লাহর সর্বশক্তিমত্তার স্মরণ করিয়ে দেয় এবং সমস্ত সৃষ্টির উপর তাঁর কর্তৃত্বের ব্যাপারে মানবজাতি এবং জিনকে সচেতন করে। যদিও মানবরা মহাবিশ্ব অন্বেষণ করার ক্ষেত্রে অসাধারণ অগ্রগতি করেছে, এই আয়াতটি জোর দেয় যে, যদি মানব এবং জিন আসমান এবং জমিনের সীমা অতিক্রম করতে চায়, তবে তারা কখনোই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া তা করতে পারবে না।
এটি আল্লাহর অদম্য ক্ষমতাকে তুলে ধরে, বিশ্বাসীদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে তাঁর হাতে সবকিছু আছে, সবকিছু থেকে শুরু করে পৃথিবী থেকে বৃহত্তম গ্রহ বা নক্ষত্রমন্ডল পর্যন্ত, এবং কোনো কিছু আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তাঁর সৃষ্টির সীমা অতিক্রম করতে পারে না।
সূরা আল-আ'রাফ (7:54) এ কুরআন আল্লাহর কর্তৃত্ব এবং দয়া সম্পর্কিত আসমান এবং জমিনের সৃষ্টির কথা বলে। আয়াতটি এভাবে পড়া হয়:
"আপনার রব আল্লাহই হলেন, যিনি আসমান ও জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আরশে অধিষ্ঠিত হলেন। তিনি রাতকে দিনের মধ্যে ঢেকে দেন, যা তাড়াতাড়ি একে অপরকে অনুসরণ করে, এবং তিনি সূর্য, চাঁদ এবং তারা সৃষ্টি করেছেন, যেগুলি তাঁর আদেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নিঃসন্দেহে, স্রষ্টা এবং আদেশ তাঁরই, প্রভু পৃথিবীর।"
এই আয়াতটি আসমান ও জমিনের সুসংগঠিত এবং উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টির উপর গুরুত্ব দেয়, যা আল্লাহ ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। এই আয়াতটি মহাবিশ্ব এবং এর মধ্যে সবকিছু উপর আল্লাহর শক্তি এবং নিয়ন্ত্রণকে তুলে ধরে। সূর্য, চাঁদ এবং তারা উল্লেখের মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টির মাপ এবং সিস্টেমের বিস্তারও প্রমাণিত হয়।
এটি আল্লাহর সর্বমহানত্ব এবং সৃষ্টির সঠিক ভারসাম্য এবং সুশৃঙ্খলতার স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিমদের এই আয়াতটি নিয়ে চিন্তা করতে উৎসাহিত করা হয় যাতে তারা আল্লাহর মহিমা এবং তাঁর সৃষ্টির নিখুঁততা বোঝতে পারে।